Test: মাথাপিছু আয় বনাম মধ্যম আয়ের চক্কর

আমরা দীর্ঘদিন ধরে, বলা যায় জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। শেষ দিকে অবশ্য আমাদের বলা হতো উন্নয়নশীল দেশ।

আমরা দীর্ঘদিন ধরে, বলা যায় জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। শেষ দিকে অবশ্য আমাদের বলা হতো উন্নয়নশীল দেশ। আজ বহুদিনের আগল ভেঙে আমরা স্বল্পোন্নত বা নিম্ন আয়ের দেশের তালিকায় থাকার কালিমা ঘুচিয়ে যখন মধ্যম আয় তথা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের চৌকাঠ পেরিয়েছি, এখন কাঙ্ক্ষিত এই প্রান্তিক প্রাপ্তিটিকে ধরে রেখে আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টাই হবে মুখ্য করণীয়। উল্লেখ্য, মধ্যম আয়ের দেশ বলতে শ্রেণীকরণ করা হয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ১২ হাজার ৭৩৫ ডলার পর্যন্ত মাথাপিছু আয়ের দেশগুলোকে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ৪ হাজার ১২৫ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশগুলোকে ধরা হয় নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ এবং ৪ হাজার ১২৬ ডলার থেকে ১২ হাজার ৭৩৫ ডলার আয়ের দেশগুলোকে ধরা হয় উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে। এর ওপরের মাথাপিছু আয়ের দেশগুলো সবই উচ্চ আয়ের দেশ। সেই হিসাবে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের সীমানায় পা রেখেছে মাত্র। এই লেখার সঙ্গে দেওয়া সারণির আয়ের হিসাব আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হলেও বিশ্বব্যাংক বা অন্য দাতা সংস্থাগুলো এই পরিসংখ্যানের ওপর আস্থা না রেখে তাদের নিজস্ব উপাত্তের ওপর নির্ভর করে। ফলে আয় হিসাবের তারতম্য ঘটতেই পারে।
জন্মসাল থেকে ১২৯ ডলার মাথাপিছু আয়কে ৪৩ বছরের মাথায় ১০ গুণ বাড়িয়ে তোলা দেশটি যে ভবিষ্যতে আরও বহুদূর যেতে পারে, সেটি এখন আর খুব সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন মনে হয় না। এই সারণি থেকে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে প্রথম দশকের মাথায় আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছিল ৭১ শতাংশ, বৃদ্ধির এই হার বেশি হওয়ার মূলে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির প্রথম বছরগুলোর অতি নিম্ন ভিত্তির আয় হার। তার পরের দুই দশকে এই আয় বৃদ্ধির হার ২৮ এবং ২৭ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায়-স্থবির। এ পর্যায়ে ২০০০-পরবর্তী অর্থাৎ নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকের বৃদ্ধির হার লক্ষণীয়, ১১৪ শতাংশ এবং তার পরের মাত্র চার বছরের মাথায় গিয়ে এই বৃদ্ধি ৭০ শতাংশে পৌঁছে গেছে। ২০২০ সালে গিয়ে সংখ্যাটা কোথায় দাঁড়াবে সেটি দেখার জন্য আমাদের আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
দারিদ্র্যের হার ১৯৭০ দশকের ৮০ শতাংশ থেকে কমে ২০১০ সালের হিসাবে নেমে এসেছে ২৬ শতাংশে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ২০০০ সালের দরিদ্র মানুষের (দৈনিক আয় ২ ডলার অথবা খাদ্য গ্রহণ ২১০০ ক্যালরির কম) সংখ্যা ৬ কোটি ৩০ লাখ থেকে কমে ২০১০-এ দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৭০ লাখে। যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ম্যাগাজিন এই সাফল্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিল, দারিদ্র্য হারের এই দ্রুত পতনশীল হার বাংলাদেশকে জাতিসংঘ নির্ধারিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে দেবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। একটি ক্রমবর্ধনশীল এবং ঘন জনসংখ্যার দেশে এ রকম সাফল্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
এই সাফল্যের পেছনের কারণ রয়েছে অনেক। বিগত দশকগুলোতে পশ্চাৎপদ কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ ক্রমেই শিল্প এবং সেবা খাতনির্ভর উন্নয়ন কৌশলের দিকে ধাবিত হয়েছে। ফলে শতাব্দী ধরে চলা কৃষি খাতের উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি স্থানান্তরিত হয়েছে শিল্প এবং অন্যান্য অসংগঠিত খাতে, যা এই অদক্ষ অথচ ছদ্ম বেকার জনশক্তির আয় বৃদ্ধি করেছে। অন্যদিকে কৃষি খাতে প্রযুক্তি এবং অন্যান্য উন্নত পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন বেড়েছে কৃষি উৎপাদনের হার, অন্যদিকে অর্থকরী ফসলমুখী প্রবণতা কৃষি খাতকে প্রান্তিক আয়ের উৎসে আটকে রাখেনি, কৃষিব্যবস্থাকে করেছে মুনাফানির্ভর। এই উভয়মুখী প্রক্রিয়া দারিদ্র্য নিরসন এবং আয় বৃদ্ধির একটা প্রধান নিয়ামক।
কৃষি খাতের এই সাফল্য পরিমাপ করার জন্য কোনো উপাত্তের প্রয়োজন পড়ে না, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং হ্রাসকৃত কৃষিজমির বিপরীতে আমদানিনির্ভরতার অবসান থেকেই হদিস মেলে এই সাফল্যের। কৃষি খাতে এই বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের বর্ধিত অবদান, অনাবাসী বাংলাদেশিদের ক্রমবর্ধমান হারে রেমিট্যান্স, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে তৃণমূল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান এবং আয় বৃদ্ধি, সেবা খাতের বিভিন্ন শাখার প্রবৃদ্ধি এবং সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার সাফল্য। বিগত কয়েক বছর ধরে পরিচালিত আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে যুক্ত করেছে অর্থনীতির কর্মপ্রবাহের মূল স্রোতোধারায়। এটির সুফল প্রাপ্তি এখন সময়ের ব্যাপার। নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীশিক্ষা প্রসারকেও চলমান সাফল্যের একটি উল্লেখযোগ্য নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। অর্থনীতির এই সফলতার হার নিঃসন্দেহে আরও বেশি হতো, যদি বিগত সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারী ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিকে স্থবির করে না দিত।
নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে উঠে আসা ধারাবাহিক সাফল্যেরই স্বীকৃতি, এ কথা মেনে নিয়েও মনে রাখতে হবে আমাদের পার হতে হবে আরও বন্ধুর পথ। কারণ, নিম্ন আয় বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসার কিছু চ্যালেঞ্জও আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। এত দিন বাংলাদেশ অনুন্নত দেশের তালিকায় থাকার কারণে দাতা সংস্থা এবং উন্নত দেশগুলো থেকে স্বল্প সুদে ঋণসহ যেসব সুবিধা ভোগ করত, কিংবা রপ্তানিতে কোটা বা জিএসপি-সুবিধার জন্য বিবেচ্য হতো, সেসব সুবিধার পথ সংকীর্ণ হয়ে যেতে পারে। উপরন্তু, মধ্যম আয়ের বিভিন্ন দেশ একটা পর্যায়ে পৌঁছার পর যে বিপাকে পড়ে, সেটির নাম মধ্যম আয়ের চক্কর। এটা এমনই একটা অবস্থা, যখন একটি দেশ মাথাপিছু আয়ের কোনো এক স্তরে পৌঁছে অন্যান্য প্রতিকূল অবস্থার কারণে এক জায়গায় গিয়ে আটকে যায় এবং সেই অবস্থা থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারে না। এর কারণ হিসেবে বলা হয় যে কৃষি খাত থেকে অকৃষি খাতে শ্রমশক্তির অবাধ সরবরাহ এবং পুঁজিঘন লাভজনক বিনিয়োগের প্রাথমিক উচ্ছ্বাস একপর্যায়ে স্তিমিত হয়ে আসে এবং প্রযুক্তি যুগোপযোগিতা হারায়।
এ পর্যায়ে অর্থনীতির চালিকাশক্তি নবায়নের জন্য প্রয়োজন হয় দক্ষ জনশক্তি, উন্নততর প্রযুক্তি এবং যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগত ভিত্তি। কিন্তু কেবল আয় বৃদ্ধিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে গিয়ে অন্যান্য দিক উপেক্ষা করার ফলে উন্নয়নের সব সহযোগী নিয়ামক নিশ্চিত করার মতো সক্ষমতা থাকে না দেশটির। এ ছাড়া উচ্চ মাথাপিছু আয়ের জোয়ারে শ্রমের মূল্য বেড়ে গেলে নিম্ন মধ্যম ও মধ্যম আয়ের দেশ হারায় রপ্তানির প্রতিযোগিতামূলক বাজার। অন্যদিকে শিল্পজাত পণ্য উৎপাদনেও উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পেরে ওঠে না এসব দেশ। ফলে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং নিম্ন প্রবৃদ্ধির কারণে মধ্য কিংবা নিম্ন মধ্যম আয়ের চক্কর থেকে বের হতে পারে না দেশগুলো। লাতিন আমেরিকার মেক্সিকো বা ব্রাজিল কিংবা আমাদের বাড়ির পাশের ইন্দোনেশিয়া বা থাইল্যান্ড এই চক্করে পড়ে আছে এখনো।
অর্থনীতিবিদেরা একসময় উপলব্ধি করেন যে উচ্চ আয়বৈষম্য থাকলে মাথাপিছু আয় দিয়ে কোনো দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য নিরূপণ করা যায় না। এই আবিষ্কারের আলোকে প্রণীত হয় (১৯৯০) জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই)। কেবল মাথাপিছু আয়ের পরিবর্তে একটি দেশের সার্বিক মূল্যায়নের জন্য আরও কিছু বিষয় নিয়ে প্রণীত এই সূচক যে অধিকতর গ্রহণযোগ্য, তার যৌক্তিকতা মেলে মধ্যম আয়ের চক্করে পড়া দেশগুলোর দৃষ্টান্ত থেকে। এই সূচকের মূল চারটি বিবেচ্য বিষয়ের একটি হচ্ছে মাথাপিছু আয়। অন্যান্য তিনটি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে জন্মকালীন সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল, স্কুলজীবনের গড় বছর এবং স্কুলজীবনে টিকে থাকার সম্ভাব্য সময়। এই সূচকের আংশিক সংশোধন করে পরবর্তী সময়ে বৈষম্য-সমন্বিত সূচক প্রবর্তন করা হয়, যাতে কেবল স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং আয়কেই বিবেচনায় নেওয়া হয় না, এসব ক্ষেত্রের প্রাপ্তির ফলাফলকে নিরূপণ করা হয় বৈষম্যের বিচারে। বৈষম্যের কারণে মানব উন্নয়নের যে ক্ষতি সাধিত হয়, সেটিই আগের সূচকের সঙ্গে এটির পার্থক্য। ২০১৩ সালের ভিত্তিতে প্রস্তুত অসাম্য-সমন্বিত সূচকের ২০১৪-এর রিপোর্টে দেখা যায়, বাংলাদেশের অবস্থান ১০৩তম, যেখানে ভারত ১০০তম এবং পাকিস্তান রয়েছে ১০৮তম অবস্থানে।
একটি দেশ মাথাপিছু আয়ের বিচারে উচ্চ অবস্থানে থেকেও মানব উন্নয়ন সূচকে পড়ে থাকতে পারে অনেক নিচে। অতএব, এ কথা সহজেই বলা যায়, কেবল মাথাপিছু আয় নিয়ে সন্তুষ্ট থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশ আটকে পড়তে পারে নিম্ন মধ্যম আয়ের চক্করে, তখন উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে যুক্ত হওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ যে মধ্যম আয়ের দেশের সর্বনিম্ন সোপানে পা রাখতে সক্ষম হয়েছে, সেই সক্ষমতা এখনো টলমল, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কিংবা বড় কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় টলিয়ে দিতে পারে এই অবস্থান। আমাদের জনসংখ্যাঘন বিশাল বাজারের কল্যাণে জিডিপির একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে অবস্থান প্রায় নিশ্চিত থাকলেও তার কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি নির্ভর করবে অন্যান্য নিয়ামক এবং সহায়ক শক্তির ওপর। সুতরাং সদ্যপ্রাপ্ত এই শিরোপা ধরে রাখার জন্য আমাদের পাড়ি দিতে হবে আরও দীর্ঘ পথ, নজর রাখতে হবে এই সাফল্য ধরে রেখে অগ্রসর হওয়ার দিকে। কেবল মাথাপিছু আয়ের আত্মতুষ্টিতে বিভোর থাকলে অর্জিত হবে না অর্থনীতি ও জনগণের সার্বিক মঙ্গলসূচক কোনো পরিকল্পনা।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
fmainuddin@hotmail.com